
মোহাম্মদ সুমন চৌধুরী, টঙ্গী, গাজীপুর: সুন্দর মনের মানুষ হতে হলে আমাদের ভাষাগত ও জ্ঞানচর্চায় নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান প্রজন্ম নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত মানুষে পরিণত হয়েছে। যা চারদিকে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এর জন্য মূলত আমরা নিজেরাই দায়ী! আমরা ক্রমাগত অপসংস্কৃতির দিকে ধাবিত হচ্ছি।
জীবনযুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার পথে আমরা সবাই ভুল করে থাকি। মানুষ হিসেবে আমরা কেউই শতভাগ ভালো নই। সবার মধ্যেই অনেক দুর্বলতা রয়েছে, অজ্ঞতা আছে। এখন আমরা যদি তা পরিহার করতে চাই, তাহলে আত্মসমালোচনার কোনো বিকল্প নেই। এটি অনেকটা আয়নার মতো। আয়নায় যেমন আমরা প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক কার্যাবলি সঠিক না বেঠিক তা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারি। জটিল অঙ্কের হিসাব মেলাতে যেমন বারবার চেষ্টা করতে হয়, তেমনি জীবনের হিসাব মেলাতে হলে ব্যক্তিজীবনের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। নতুবা পালহীন নৌকার মতো জীবন উদ্দেশ্যহীনভাবে চলতে থাকে। আরবিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘সবচেয়ে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বা বিচক্ষণ মানুষ হলো ওই ব্যক্তি যে নিজের দোষ-ত্রম্নটি দেখে।’ কিন্তু আমরা অন্যের ভালো-মন্দের বিচার যেভাবে করতে পারি, সেভাবে নিজের বিচার করি না। এমন মানুষ কমই খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা অন্যের দোষ-ক্রুটি উদঘাটনের পূর্বে আত্মসমালোচনা করেন। অধিকাংশ মানুষ নিজে ভ্রান্তির মধ্যে ডুবে থেকে অন্যের সংশোধনে বেশি উদগ্রীব থাকেন! অন্যের দায়িত্ব যেন তার কাঁধে পড়েছে। আমরা প্রকাশ্যে অন্যের সমালোচনা করি আবার নিজেও তাতে লিপ্ত হই। যেন আমি ছাড়া পৃথিবীর সবাই খারাপ। নিজেকে উপেক্ষা করে শুধু অন্যের দোষ চর্চা করলে সমাজে পরিবর্তন আসে না। নিজেকে আবিষ্কার করতে পারাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেকে জানার চেষ্টা করলেই প্রকৃত সার্থকতা পাওয়া যায়। সত্য আমাদের ডাকে সাড়া দেয়। সমাজব্যবস্থা পরিশুদ্ধ ও উন্নত হয়।
আমাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যর্থতার বোঝা অন্যের ওপর চাপিয়ে দিই। পরীক্ষায় আমাদের আশানুরূপ ফলাফল না হলে শিক্ষকের দোষ, প্রতিষ্ঠানের দোষ, সিস্টেমের দোষ। অথচ পড়াশোনা না করে দিনরাত যখন ভবঘুরে হয়ে সময় নষ্ট করি, সেটা বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলা বা নেশার জগতে ডুব দেওয়া অলস ছেলেটাও একসময় বেকার হয়ে সিস্টেমের দিকে আঙ্গুল তোলে। সমাজব্যবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে। বিশ্বায়নের তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ যুগে অন্যের সমালোচনা করে এলে কোনো লাভ নেই। আলোকিত মানুষ হওয়ার চেষ্টায় সবাই তৎপর। কেউ আপনার নায্য অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বসে নেই। নিষ্ঠুর এ পৃথিবীতে আপনাকে নিজের অধিকার বুঝে নিতে হবে। হতে হবে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। অন্যথায় এ সমাজ আপনাকে গণ্য করবে না। আমরা সবাই সিস্টেমের দোষ দিই। অথচ সিস্টেম পরিবর্তনের জন্য কতটুকু ভূমিকা রেখেছি আমরা? পরিবার, রাষ্ট্র থেকে আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথার্থভাবে মানার চেষ্টা করি আমরা! আমরা নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করি না অথচ স্বপ্ন দেখি পৃথিবী বদলে যাবে। এটা কী আদৌ সম্ভব? পরিবর্তনের জন্য দরকার পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক মানুষ। আর যিনি নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের কাজ করেন, তিনিই দেশপ্রেমিক। বিভিন্ন চেতনার বুলি আউড়ে, চাটুকারিতা করে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের চেয়ে যারা নিজের কাজটা একাগ্রচিত্তে করে যান, তারাই সোনার বাংলার সোনার সন্তান।

নোংরা রাস্তা দেখলে আমরা সমালোচনা করতে শুরু করি, আবার আমরাই অসতর্ক হয়ে বা ইচ্ছে করেই উচ্ছিষ্ট বস্তু ফেলি চলার পথে। এমন যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা মানুষটাও একসময় দোষ দেয় সিস্টেমকে। আমরা সবাই নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাবার প্রাপ্তির প্রত্যাশা করি। অথচ বাজারে গিয়ে কৃত্রিম আকর্ষণীয় রঙের ফল না হলে আমরা কিনতে চাই না। রাস্তা-ঘাটে আমরা অন্যের মা-বোনের দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করি অথচ আমাদের পরিবারের সঙ্গে এমনটা হলে ক্ষুব্ধ হই। আমরা এমন অনেক দিকনির্দেশনা ও বক্তব্য দিয়ে থাকি যা আমরা কখনই করি না।
আমরা বিপক্ষ মতকে একেবারেই সহ্য করতে পারি না। ভিন্ন মত দেখলেই গা জ্বালা করে। আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করার চেয়ে কাদা ছোড়াছুড়ির চর্চা করে থাকি। এদেশে দলীয়করণ রাজনীতিতে দেশপ্রেম মুখ্য বিষয় নয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমাদের লোভাতুর মন দুর্নীতির হাতছানিকে রুখতে পারে না। এ দেশের সর্বাঙ্গে যে মরিচা পড়েছে তা থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে। সুশাসন ও সাধারণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের উন্নতি মানেই কিন্তু আমাদের উন্নতি।
মানুষের প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা দিতে আমরা ভুলে গেছি। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অধিকাংশ অপরাধীরাই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে শৈশবে বা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, বঞ্চনা ও ভালোবাসাহীনতার দাবানলে দগ্ধ হয়ে। মানুষ হিসেবে আমরা সবসময় চাই, অন্যরা যেন আমাদের ভালোবাসে। কিন্তু আমরা অন্যকে প্রকৃতই মানুষ হিসেবে গণ্য করতে চাই না।
আমাদের নফসের কুমন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ যুদ্ধে টিকে থাকতে না পারলে আমাদের পরাজয় সুনিশ্চিত। নিজের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ভুলগুলো শুধরানো সবচেয়ে বেশি জরুরি। সুন্দর মুহূর্তগুলো যেন অপ্রীতিকর কর্মে নষ্ট না হয় সেদিকে সুদৃষ্টি দিতে হবে। নিজের মধ্যে সবজান্তা ভাব দূর করতে হবে। সব কার্যক্রমে বিবেকের আদালত জাগ্রত করে বিচার করতে হবে। ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে চিন্তিত হতে হবে। অন্যরা আমাকে মূল্যায়নের আগে, নিজেকে নিজেই মূল্যায়ন করে সঠিক পথে ফিরে আসতে পারলেই জীবনের সার্থকতা।