
সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে প্রতিক্ষার এক মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যে তাকওয়াভিত্তিক চরিত্রগঠনের অনুশীলন করে থাকি, তার সমাপনী উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদ অর্থ উৎসব আর ফিতর অর্থ না খেয়ে থাকার পর খাবার গ্রহণ করা। ঈদুল ফিতর বলতে যা বুঝায় আরবি ফিতর বা ফুতুর অর্থ প্রকৃত পক্ষে তাই। আত্মসংযমের শক্তি অর্জনের জন্য দীর্ঘ এক মাসব্যাপী রাতের শেষ থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া হতে বিরত থাকার একটা মহড়ায় আমরা অংশগ্রহণ করে থাকি রামাদানুল মোবারকে। আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে এভাবে আত্মসংযম ও তাকওয়ার এবং আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে নির্ধারিত একটি প্রশিক্ষণ সমাপনের পর আবার দিবাভাগে খাওয়া-দাওয়ার অনুমতি আসে।
প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পরের দিনের উৎসবটি নিছক খাবার সুযোগকে কেন্দ্র করে নয় বরং এক মাসের নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ সাফল্যের সাথে সমাপনের আনন্দই এখানে প্রধান।
বছর ঘুরে আবারো ফিরে এলো আনন্দ খুশির বড় উপলক্ষ ঈদুল ফিতর। বাংলাদেশের মুসলিম জনসাধারণ শুধু ঈদ উদযাপন করছে তা নয় বরং বিশ্ব মুসলমানরাও এই সময়ে ঈদ উদযাপনে শামিল। রোজার শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে ঘিরে মুসলমানদের মাঝে আনন্দ উৎসবের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বশ্রেণির মানুষ এই ঈদে মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। প্রাণে প্রাণে বইবে এ দিনে খুশির জোয়ার। বছরের এই দিনটি কাটে খুবই উচ্ছ্বাসমুখরতায় ও জান্নাতি খুশির আমেজে-আবহে অগণিত মুসলিমকে ঘিরে। ঈর্ষা, দ্বেষ, অনৈক্য-দূরত্ব ও বিভাজনের যে প্রবণতা- এই দিনে তা থাকবে না। মানুষে মানুষে মিলনের মধ্য দিয়ে দূর হবে অমানবিকতা ও বিদ্বেষ-বিভেদের পাতানো যত নিষ্ঠুরতার খেলা।
ইসলামের অর্থনৈতিক সাম্যের বিধান এ দিনই মূর্ত হয়ে ওঠে। সবাই নতুন পোশাক পরিধান, একই মাঠে জমায়েত, একই ইমামের পেছনে তাকবির ধ্বনির সঙ্গে নামাজ আদায়, বুকে বুক মিশিয়ে কোলাকুলি- এক নয়নাভিরাম স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারণা করে। দীর্ঘ রোজার পর ঈদুল ফিতর পরিশুদ্ধ আত্মাকে সিরাতুল মুস্তাকিমে অবিচল রাখতে প্রেরণা জোগায় এবং দীর্ঘ তাকওয়ার প্রশিক্ষণকে বাস্তব রূপ দিতে শুরু করে। এক টুকরো চাঁদ একটি জাতির জীবনে কতখানি আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত শাওয়ালের নতুন এক ফালি চাঁদ। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো- ঈদের প্রকৃত চেতনা ও শিক্ষা থেকে আমরা যোজন দূরত্বে থাকায় এর ফজিলত ও মাহাত্ম্য ভুলে গেছি। ঈদ যেন আজ কেবলই আচার-আনুষ্ঠানিকতা ও খেল তামাশায় রূপ নিয়েছে।
ঈদের মূল শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ছেড়ে মুসলিম জাতি ক্রমশই ভোগবাদী অপসংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ভোগসর্বস্ব জীবনই বেছে নিচ্ছে আমাদের অনেকেই। অথচ নিঃস্ব অসহায়দের মুখে হাসি ফোটানোই ঈদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও শিক্ষা। আজ ঈদের মূল শিক্ষা আমাদের মধ্যে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যথিতের কষ্ট দূর করা ও তার ব্যথায় সমব্যথী হওয়াই ঈদের শিক্ষা। সেই ব্যথিত ব্যক্তি আমার প্রতিবেশী হোক, আত্মীয় হোক কিংবা তার অবস্থান হোক যোজন দূরে। পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে প্রতিনিয়ত আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই কমছে মানুষের দাম। শান্তি, স্বস্তি নেই কোথাও। সর্বত্র অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, জুলুম, নিপীড়নের ভেতর দিয়ে আমাদের নিত্য পথচলা। ফিলিস্তিন ও ভারতের মুসলমানরা আজ করুণ অবস্থার শিকার। পরাশক্তির হিংসাত্মক ছোবলে সমগ্র মুসলিম জনপদ আজ ক্ষতবিক্ষত ও দলিত। সেখানে তাদের জীবন ও স¤পদের কোনো নিরাপত্তা নেই। পরাশক্তির অস্ত্রের গোলায় ছিন্নভিন্ন হচ্ছে মুসলিম জনপদ। সুতরাং ঈদুল ফিতরের আনন্দের মুহূর্তে দুর্দশাগ্রস্ত নিপীড়িত মজলুম মানবতার কথাও আমাদের ভাবতে হবে। কিভাবে একটি সুখী সমৃদ্ধ মানবতাবাদী বিশ্ব গড়া যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে জাতীয় ও বিশ্বনেতৃত্বকে।
শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ততা নয়, চারপাশে চোখ মেলে তাকাতে হবে আমাদের। অভাবী, দুঃখক্লিষ্ট নিরন্ন মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই যে ঈদের আসল শিক্ষা তা আমাদের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। মেকি অশ্লীল ভোগসর্বস্ব আনন্দ উৎসবে মত্ত না হয়ে নিগৃহীতদের ব্যথায় ব্যথিত হয়ে ঈদ পালন করা প্রয়োজন। ঈদের প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনের মাধ্যমে ধনী-গরিব সবার মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় ও মজবুত হোক। বিভেদ বিদ্বেষ ভুলে গড়াগড়ি-কোলাকুলিতে কাটুক এই দিন।
মানুষে মানুষে মেলাতে, একে অপরের সঙ্গে মানবিক স¤পর্ক ঘনিষ্ঠ করার যে বার্তা ও আহ্বান নিয়ে রোজা এবং ঈদ আসে বছর ঘুরে, তা সবাই সমভাবে উপভোগ-উপলব্ধি করতে পারে জোর দিয়ে এই দাবি করা যায় না। বরং এই রোজা ও ঈদ গরিব, ভাগ্য বিড়ম্বিত, অভাবী মানুষের জন্য অনেক সময় বিষাদতুল্য ঠেকে এক শ্রেণির বিত্তবানদের ভোগবাদী জীবনদৃষ্টির কারণেই। ঈদ সর্বজনীন আনন্দোৎসব। ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন জীবনবোধে সমৃদ্ধ হওয়ার প্রেরণার নামই রোজা। অথচ এই গরিব দেশে চার পাশে আমরা কী দেখছি? ত্যাগ ছেড়ে, আত্মশুদ্ধির পথ ছেড়ে বস্তুমোহে, বিলাসী জীবনে গা ভাসিয়ে দেয়ার মহোৎসব যেন চলে রোজা-ঈদ মৌসুমে। শক্তিমান-বিত্তবানদের দাপটে-উপহাসে গরিব মানুষগুলোর চোখে-মুখে আজ হাসি নেই। এদের আনন্দ-খুশি কেড়ে নেয়া হচ্ছে। লাখ দেড় লাখ টাকা দামের বাহারী পোষাক এই ঈদে ধনীরা প্রতিদিনই হজম করে নিচ্ছে, ঈদকে বিলাস জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ধরে নিয়ে বাহারি পণ্য ক্রয়ের উৎসবে ধনীরা মেতে আছে মাসজুড়ে। অথচ তার আশপাশের শত শত গরিব অভাবী মানুষ নিজ স্ত্রীর জন্য এখনো শ’ তিন শ’ টাকা দামের একটি কাপড়, নিজের জন্য একটি সাধারণ লুঙ্গি, বাচ্চাদের জন্য কম দামের প্যান্ট-শার্ট কেনার সামর্থ্যও রাখে না। লাখ-দু’লাখ টাকার বাজেট নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে ঈদের আনন্দের সবটুকুই ধনীরা লুফে নেয়। অন্যদিকে গরিব মানুষেরা এই ঈদে জনপ্রতি একটি নিম্নমানের পোশাকও কিনতে পারে না। দারিদ্র্যের সীমাহীন কশাঘাতে ওরা জর্জরিত। ওরা বিপন্ন।
আমাদের দেশের বিভিন্ন দুর্যোগে গৃহহারা, ছিন্নমূল পথশিশুদের দিকে এই ঈদে একটু নজর দিন। তাদের প্রয়োজন পূরণ করুন। সুখে-দুঃখে সমব্যথী হোন। এই মানবিক দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র, বিদ্বান-বিত্তবান সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। তৃণমূলের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের চোখে-মুখেও থাকে যেন ঈদের হাসি, আনন্দের ঝিলিক। এটাই রোজা ও ঈদের অন্তর্নিহিত দর্শন ও আহ্বান।
ঈদুল ফিতরের আনন্দ সবাইকে ছুঁয়ে যাক এই কামনা। সাংবাদিক অধিকার বাস্তবায়ন সোসাইটির সকল সহযোদ্ধা ও দেশবাসীসহ গোটা বিশ্ববাসীকে জানাই পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন। ঈদ মোবারক।
আমার লেখাটি ভালো লাগলে কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করলে খুশি হবো৷