
শবে বরাত (লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান) সম্পর্কে অনেক আলোচনা হয়ে থাকে। কেউ একে বিশেষ গুরুত্ব দেন, আবার কেউ এ রাতের ফজিলতকে অস্বীকার করেন। তাই আসুন, কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে এ রাতের প্রকৃত বিধান ও শা‘বান মাসের রোযার গুরুত্ব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
শবে বরাত সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি
কুরআনে সরাসরি “শবে বরাত” নামে কোনো রাতের উল্লেখ নেই। কিছু মানুষ সূরা আদ-দুখানের আয়াতকে শবে বরাতের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন—
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ
“নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) এক মহিমান্বিত রাতে অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা আদ-দুখান: ৩)
কিন্তু অধিকাংশ তাফসিরবিদ একমত যে, এখানে বলা “মহিমান্বিত রাত” হচ্ছে লাইলাতুল কদর, যা রমজানের শেষ দশকে অবস্থিত (সূরা কদর: ১-৫, সূরা বাকারা: ১৮৫)। তাই এই আয়াত শবে বরাতের ফজিলতের দলিল হতে পারে না।
হাদীসের আলোকে শবে বরাত
কিছু হাদীসে শা‘বান মাসের ১৫তম রাতের বিশেষ ফজিলতের কথা বলা হয়েছে, যেমন—
- আল্লাহ এই রাতে বান্দাদের ক্ষমা করেন:
- হাদীসে এসেছে, “আল্লাহ তাআলা মধ্য শা‘বান রাতে দুনিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।” (ইবনু মাজাহ: ১৩৯০, সহীহ লিগাইরিহি)
- শা‘বান মাসে রাসুল (ﷺ) রোযা রাখতেন:
- আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “রাসুলুল্লাহ (ﷺ) শা‘বান মাসে এত বেশি নফল রোযা রাখতেন যে আমরা ভাবতাম তিনি হয়তো পুরো মাসই রোযা রাখবেন।” (বুখারি: ১৯৭০, মুসলিম: ১১৫৬)
আইয়ামে বীজের রোযা ও তার গুরুত্ব
শা‘বান মাসের ১৫তম দিনে অনেকেই বিশেষ রোযার কথা বলেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যে রোযাগুলো বিশেষভাবে রাখতে উৎসাহিত করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো আইয়ামে বীজের রোযা।
আইয়ামে বীজ কী?
প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে “আইয়ামে বীজ” বলা হয়। এই দিনগুলোতে নফল রোযা রাখা রাসুল (ﷺ)-এর একটি নিয়মিত অভ্যাস ছিল।
✅ রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
“তুমি যদি প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখ, তবে চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখো।” (তিরমিজি: ৭৬১, সহীহ)
✅ আরও এক হাদীসে এসেছে:
“এই তিনটি রোযা পুরো মাস রোযা রাখার সমান সওয়াব এনে দেয়।” (নাসাঈ: ২৪৩৪)
শবে বরাতে বিশেষ ইবাদত করা উচিত কি না?
কোনো সহীহ হাদীসে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বা সাহাবাগণ শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ নামাজ, মসজিদে জমায়েত, আতশবাজি বা হালুয়া-রুটি খাওয়ার প্রথা পালন করেছেন এমন প্রমাণ নেই।
তবে, মধ্য শা‘বানের রাতে ইবাদত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধও নয়। ব্যক্তি যদি সাধারণ নফল ইবাদত (নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া ইত্যাদি) করে, যা তিনি অন্য সময়ও করেন, তাহলে তা জায়েজ। কিন্তু একে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ মনে করে উদযাপন করা বিদআত হিসেবে গণ্য হবে।
শবে বরাত কেন্দ্রিক ভ্রান্ত আকীদাসমূহ: কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিশ্লেষণ
শবে বরাত (লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান) নিয়ে মুসলিম সমাজে বিভিন্ন ভুল বিশ্বাস ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। যদিও কিছু হাদীসে শা‘বান মাসের ১৫তম রাতের ফজিলত পাওয়া যায়, তবে এর সাথে জুড়ে দেওয়া অনেক ধারণা সহীহ হাদীসের আলোকে ভিত্তিহীন বা দুর্বল। তাই আসুন, শবে বরাত সংক্রান্ত ভ্রান্ত আকীদাসমূহ পর্যালোচনা করি এবং সহীহ ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো বুঝার চেষ্টা করি।
১. শবে বরাতকে বিশেষভাবে ইবাদতের রাত মনে করা
অনেকেই মনে করেন যে, শবে বরাত একটি বিশেষ ইবাদতের রাত, যেখানে নির্দিষ্ট নামাজ, বিশেষ দোয়া ও মসজিদে জমায়েতের মাধ্যমে ইবাদত করা আবশ্যক। কিন্তু এই ধারণার পক্ষে কোনো সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস নেই।
✅ সহীহ মতামত:
ইবাদতের জন্য শবে বরাতকে নির্দিষ্ট করা রাসুল (ﷺ) ও সাহাবিদের আমল দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে, যে কেউ যদি নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত ও দোয়া করতে চান, তা করতে পারেন, তবে একে বিশেষ রাত বলে মনে করা বিদআত হবে।
২. শবে বরাতে বিশেষ নামাজ (নফল সালাতুল বরাত) পড়া
বিভিন্ন সমাজে “শবেবরাতের নামাজ” নামে একটি বিশেষ নামাজ প্রচলিত আছে, যেখানে ৬, ১০, ১২, বা ১০০ রাকাত নামাজ পড়ার কথা বলা হয়। অনেকে বলেন, প্রতি রাকাতে নির্দিষ্ট সূরা পাঠ করতে হবে।
✅ সহীহ মতামত:
শবে বরাতের বিশেষ কোনো নামাজের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো হাদীস নেই। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, “শবে বরাত উপলক্ষে নির্দিষ্ট কোনো নামাজের কথা সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না।” (আল মাজমু‘, ৩/৫৪৮)
৩. শবে বরাতে ভাগ্য নির্ধারণ হয়
অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এই রাতে মানুষের ভাগ্য লেখা হয়, জীবনের হায়াত কমানো-বাড়ানো হয় এবং রিযিক নির্ধারণ করা হয়।
✅ সহীহ মতামত:
এই ধারণার জন্য সাধারণত সূরা আদ-দুখানের আয়াতকে দলিল হিসেবে আনা হয়—
“নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চয়ই আমরা সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারণ করা হয়।” (সূরা আদ-দুখান: ৩-৪)
কিন্তু অধিকাংশ তাফসিরবিদ একমত যে, এখানে বলা “বরকতময় রাত” হলো লাইলাতুল কদর, যা রমজানের শেষ দশকে অবস্থিত (সূরা কদর: ১-৫, সূরা বাকারা: ১৮৫)।
শরীয়ত মতে, মানুষের তাকদীর (ভাগ্য) লাওহে মাহফুজে লিখিত থাকে এবং তা লাইলাতুল কদরে ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাই শবে বরাত ভাগ্য নির্ধারণের রাত নয়।
৪. শবে বরাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের জন্য বিশেষ দোয়া করা
অনেক মানুষ শবে বরাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃতদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য বিশেষ দোয়া করে এবং মনে করে যে, এ রাতে মৃতদের আত্মা তাদের পরিবারের কাছে আসে।
✅ সহীহ মতামত:
মৃতদের জন্য দোয়া করা ইসলামসম্মত, তবে শবে বরাতকে কবর জিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা বিদআত। রাসুল (ﷺ) সারা বছরই কবর জিয়ারত করতেন, কিন্তু শবে বরাতের রাতে বিশেষভাবে কবর জিয়ারতের কথা কোনো সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না।
৫. শবে বরাতের রাতে হালুয়া-রুটি খাওয়ার বিশেষ নিয়ম
বিভিন্ন সমাজে শবে বরাত উপলক্ষে হালুয়া-রুটি ও বিশেষ খাবার তৈরি করা হয় এবং এটিকে সওয়াবের কাজ হিসেবে দেখা হয়।
✅ সহীহ মতামত:
শরীয়তে এ ধরনের প্রথার কোনো ভিত্তি নেই। যদি কেউ পারিবারিকভাবে বা সাধারণ অভ্যাস অনুযায়ী খেতে চায়, তবে তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু এটিকে “শবে বরাতের বিশেষ খাবার” মনে করা বিদআত।
৬. শবে বরাতে আল্লাহ দুনিয়ার কাছাকাছি এসে দোয়া কবুল করেন
অনেকে বলেন, আল্লাহ শবে বরাতে বিশেষভাবে দোয়া কবুল করেন।
✅ সহীহ মতামত:
আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবীর কাছাকাছি আসেন এবং বান্দাদের ডাকেন:
“আমি কে আছি যে, আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেব?” (বুখারি: ১১৪৫, মুসলিম: ৭৫৮)
এটি প্রতিদিনের ঘটনা, শুধুমাত্র শবে বরাতের জন্য নির্দিষ্ট নয়।
৭. শবে বরাতে বিশেষ ফজিলতের কথা বলা কিছু দুর্বল ও জাল হাদীস
❌ “শাবান মাসের ১৫ তারিখে রাত জেগে নামাজ পড়ো এবং দিনে রোযা রাখো।” (ইবনু মাজাহ: ১৩৮৮, জাল)
❌ “এই রাতে আল্লাহ বান্দাদের তাকদীর নির্ধারণ করেন।” (বায়হাকি, দুর্বল)
❌ “এই রাতে আল্লাহ কবরবাসীদের মুক্তি দেন।” (তাবারানি, দুর্বল)
আমাদের করণীয় কী?
✅ শা‘বান মাসে বেশি বেশি নফল রোযা রাখা, বিশেষ করে আইয়ামে বীজের (চাঁদের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোযা রাখা সুন্নাহ) রোযা পালন করা।
✅ মধ্য শা‘বানের রাতে একাকী ইবাদত করা যেতে পারে, তবে বিশেষ কোনো নিয়ম বা আমল বিশ্বাস করা ঠিক নয়।
✅ শিরক ও বিদআত থেকে বেঁচে থাকা।
উপসংহার
শবে বরাতের ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে বোঝা যায় যে, এই রাতের বিশেষ কোনো ফজিলত নির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত নয়। তবে, আল্লাহর ক্ষমার দরজা সবসময় খোলা থাকে। তাই এই রাতেও অন্যান্য নফল ইবাদতের মতো ইবাদত করা যেতে পারে, কিন্তু একে বিশেষ কোনো ধর্মীয় উৎসব বা আনুষ্ঠানিক রীতি হিসেবে পালন করা ঠিক নয়।
অন্যদিকে, আইয়ামে বীজের রোযা সুন্নাহসম্মত এবং এটি শা‘বানসহ বছরের প্রতিটি মাসেই পালন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল।
লেখকঃ নিয়াজ মোর্শেদ সিয়াম।
ডিপ্লোমা ইন ইসলামিক স্ট্যাডিজ।