
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: ট্টগ্রাম শহরের হালিশহর এইচ-ব্লক জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি প্রফেসর নুরুল আবছার গত শুক্রবার জুমার নামাজের সময় মসজিদে মুসল্লিদের উদ্দেশে তাঁর এক বক্তব্যে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি রমজান মাস ঘিরে এলাকায় পুলিশের টহল ও নজরদারি চেয়ে নিকটবর্তী থানায় একটি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ সেই আবেদন ফিরিয়ে দিয়েছে। তাঁকে জানানো হয়েছিল, বর্তমানে পুলিশ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত আছে। এলাকাবাসীকে নিজেদের নিরাপত্তা নিজেদের নিতে পরামর্শ দেয় পুলিশ।
ওই এলাকাটির মতো বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বেশির ভাগ এলাকায় আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে শঙ্কা বিরাজ করছে। সাধারণের জানমালের নিরাপত্তায় যে পুলিশ বাহিনী নিয়োজিত, তাঁরা নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় আছে। গত প্রায় দুই মাসে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ সদস্যদের ছুরিকাঘাত, মারধর বা শারীরিকভাবে হেনস্তার অন্তত সাতটি ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে বর্তমানে বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য নতুন। ফলে বিশাল এই বন্দরনগরীর অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলো সম্পর্কে জানাশোনা কম থাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। চট্টগ্রাম শহরের একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দৈনিক বাংলার বিপ্লব পত্রিকাকে বলেন, তাঁর থানার মাঠপর্যায়ে যেসব এসআই ও এএসআই রয়েছেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ চট্টগ্রাম শহরে নতুন।কর্মস্থল, অপরাধ জোন (এলাকা) ও অপরাধীদের বিষয়ে জানাশোনা কম থাকায় তাঁদের কাজে সমস্যা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার পর তাঁদের টহলে পাঠানোও কষ্টকর হচ্ছে।
পুলিশের পরিদর্শক পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মানুষের মধ্য থেকে পুলিশের ভয় কেটে গেছে বলা যায়। তুচ্ছ কারণেও মানুষ এখন পুলিশের ওপর আক্রমণাত্মক আচরণ করছে।এতে দারোগারা (এসআই) টহলে যেতে চান না।দিনের বেলায় স্বাভাবিক থাকলেও বিশেষ করে গভীর রাতে দারোগাদের শাস্তির ভয় দেখিয়েও টহলে পাঠানো যায় না। এ ছাড়া পুলিশের নানা দাবিদাওয়া এখনো পূরণ না হওয়ায় তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।মামলার তদন্ত ও আসামি গ্রেপ্তার অভিযানে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না তাঁরা।এতে করে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে রুটিন পুলিশিংয়েও। এটার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীদের কয়েকটি চক্র।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশে স্কুল থেকে ছেলেকে আনতে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের হাতে শারীরিক হেনস্তার শিকার হয়েছেন নগরের কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি নেজাম উদ্দিন।
১৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটে চেকপোস্ট বসিয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশায় তল্লাশির সময় ওই গাড়িতে থাকা যাত্রীরা দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায় ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়।
৯ ফেব্রুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২টায় কোতোয়ালি মোড়ে সড়ক আইনে ট্রাফিক পুলিশের মামলা দেওয়ায় প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন সিএনজি অটোটেম্পো চালকেরা।
১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে চান্দগাঁও সড়কে অবৈধ সিএনজিচালিত অটোরিকশা উচ্ছেদ চালাতে গেলে ট্রাফিক পুলিশের দুই সদস্যের ওপর হামলা চালান চালকেরা।
২৫ ফেব্রুয়ারি নগরের ডবলমুরিং থানাধীন বারিক বিল্ডিং মোড়সংলগ্ন ছিনতাইকারীদের আস্তানায় অভিযানে গিয়ে পুলিশের দুই এসআই ছুরিকাঘাতের শিকার হয়েছেন।২৭ ফেব্রুয়ারি বেলা ২টায় হালিশহর থানাধীন বড়পোল মোড়ে মামলা করায় ব্যাটারি রিকশাচালকেরা মিলে এক ট্রাফিক পুলিশকে মারধর করেন।
সর্বশেষ ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টায় নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের চরপাড়া ঘাটের কাছে গাঁজাসেবনে বাধা দেওয়ার জেরে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে পরিকল্পিত ‘মব’ তৈরি করে মারধর করেছে সংঘবদ্ধ একটি অপরাধী চক্র। ওই কর্মকর্তার মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ছাড়াও ওয়্যারলেস সেট ছিনিয়ে নেওয়া হয় ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহমুদা বেগম দৈনিক বাংলার বিপ্লব পত্রিকাকে বলেন, ‘ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পুলিশের মনোবলে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল।পরে ঊর্ধ্বতনদের দিকনির্দেশনা ও নানা পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে এটা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। এখন পুলিশের মনোবলে কোনো সমস্যা নেই। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের টহল জোরদার আছে।’
অতিরিক্ত উপকমিশনার আরও বলেন, ‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকবে, এটা স্বাভাবিক। এসব ঘটনায় আমরা তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে যাচ্ছি। পতেঙ্গায় পুলিশ সদস্যের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটল, সেখানে কিন্তু পুলিশ দ্রুত ওই হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনেছে। অন্যান্য ঘটনার ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’ চট্টগ্রাম শহরে অনেকের নতুন কর্মস্থলের বিষয়ে মাহমুদা বেগম বলেন, ‘এটা সত্য। বদলিজনিত কারণে চট্টগ্রাম শহরটি অনেকের কাছে নতুন হওয়ায় নগরের ক্রাইম জোন সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কম। এতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।আশা করছি, এগুলোও দুই-তিন মাসের মধ্যে কেটে যাবে।’
পতেঙ্গার হামলায় ১০ জন গ্রেপ্তার
পতেঙ্গায় আইনশৃঙ্খলা দায়িত্ব পালনের সময় এসআই মারধরের ঘটনায় আরও ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শনিবার রাতভর নগরীর পাঁচলাইশ থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে পতেঙ্গা থানার পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন গণপতি (৫৭), হামিদুর রহমান (৩০), রোহান (২০), আরিফ প্রামাণিক (৩৫), রাব্বি (৩৫), শুভ (১৯), জীবন (২৬), রুমেল (৩০), রেজাউল করিম (৪৫) ও সিয়াম শেখ (১৮)।
পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, এরা মাদকসেবন ও ছিনতাইয়ে জড়িত। তারা পতেঙ্গা থানার এসআই ইউসুফ আলীকে দলবদ্ধ হয়ে পরিকল্পিতভাবে মারধর করেছিল।
ওই রাতে স্থানীয় জনতা দুজনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় একটি মামলা করা হয়।